সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়: কেন ৭৯ বছর বয়সেও ছোট পর্দায় অদম্য এই কিংবদন্তি?
টেলিপাড়ায় এখন এক অদ্ভুত প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। একের পর এক বর্ষীয়ান অভিনেত্রী ছোট পর্দা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। দীর্ঘদিনের কর্মজীবনের ক্লান্তি, চরিত্রের একঘেয়েমি, আর শুটিংয়ের অনিয়মিত সময়সূচি তাঁদের বাধ্য করছে ধারাবাহিকের জগত থেকে সরে আসতে। অথচ, এই স্রোতের ঠিক উল্টো পথে হেঁটে চলেছেন প্রবীণ অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। এক সময় বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগে যার অভিনয় মুগ্ধ করেছে অসংখ্য দর্শককে, আজ সেই কিংবদন্তি নিয়মিত কাজ করছেন ছোট পর্দায়, নতুন প্রজন্মের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। যখন অনেকেই বিশ্রামের পথ বেছে নিচ্ছেন, তখন তার এই অবিচল থাকার পেছনের গল্পটি কেবল চমকপ্রদই নয়, অনুপ্রেরণামূলকও বটে।
টেলিপাড়ার বর্তমান চিত্র: কেন মুখ ফেরাচ্ছেন প্রবীণরা?
ছোট পর্দার কাজ মানেই এক ভিন্ন বাস্তবতা। একটি ধারাবাহিকের শুটিং মানে টানা ১২-১৪ ঘণ্টা সেটে থাকা। প্রতিদিনের রুটিনে থাকে চরম অনিশ্চয়তা – কখন ‘কলটাইম’ আসবে, কখন শট হবে, তা অনেক সময় আগের রাতেও সঠিকভাবে জানা যায় না। এই অনিয়ম এবং দৈহিক ধকল অনেক বর্ষীয়ান শিল্পীর কাছেই ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি, জনপ্রিয় অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্তী খোলাখুলিভাবে জানিয়েছেন, ছোট পর্দায় অভিনয় করতে তার আর ভালো লাগে না। তার অভিযোগ, শুরুর দিকে একটি ধারাবাহিকের গল্প যতটা অর্থবহ ও আকর্ষণীয় থাকে, দিন গড়ানোর সাথে সাথে তার গভীরতা হারিয়ে যায়। একই সুর শোনা গেছে অনামিকা সাহা এবং রত্না ঘোষালদের কণ্ঠেও। তাদের মতে, একঘেয়ে কাজ, শারীরিক ক্লান্তি আর সৃজনশীলতার অভাব তাদের ছোট পর্দার কাজ থেকে অনেকটাই দূরে ঠেলে দিয়েছে। চরিত্রগুলো অনেক সময় এক মাত্রায় চলতে থাকে, যা শিল্পীর অভিনয় প্রতিভাকে নতুন করে মেলে ধরার সুযোগ দেয় না। এই কারণে, অনেকেই সম্মানজনকভাবে ছোট পর্দা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন, কিছুটা অবসর যাপন এবং কিছুটা নতুন ধরনের কাজের খোঁজে।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়: ব্যতিক্রমী এক শিল্পীর দৃঢ়তা
যখন সবাই এই দলে নাম লেখাচ্ছেন, তখন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ব্যতিক্রমী এক উদাহরণ স্থাপন করছেন। তিনি এই দলে নাম লেখাতে একেবারেই নারাজ। তার কাছে শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা ব্যক্তিগত ভালো লাগা-মন্দ লাগার ঊর্ধ্বে। আনন্দবাজার অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সোজাসাপ্টা ভাষায় বলেছেন, “ভালো না লাগলেও করতে হবে। যে শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছি, সেখানে কোনো কিছু বাদ দিলে চলে না।”
তার এই উক্তি যেন শিল্পীর এক গভীর নিষ্ঠা আর পেশাদারিত্বের প্রতিচ্ছবি। তার মতে, অভিনয় মানেই সব সময় সুখের অভিজ্ঞতা হবে—এমনটা নয়। কখনো ক্লান্তি আসবে, কখনো একঘেয়েমি ভর করবে, কিন্তু শিল্পীর দায়বদ্ধতা তাকে সেটে টেনে নিয়ে যাবেই। তিনি বলেন, “ভালো-মন্দ তো সবকিছুর সঙ্গেই মিশে থাকে। মুখ দেখানো উচিত। না হলে মানুষ বুঝবে কী করে আমি আছি, এখনও শুয়ে পড়িনি।” এই কথাটি তার জীবনে চলার পথে এক মন্ত্রের মতো কাজ করে। এটি কেবল একটি বাক্য নয়, বরং তার অস্তিত্বের জানান দেওয়া, তার শিল্পের প্রতি অদম্য ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
কাজের প্রতি ভালোবাসা: ক্লান্তি দূর করে প্রশান্তি
শারীরিক কষ্ট হয় না, তা নয়। এই বয়সে দীর্ঘ সময় শুটিং সেটে থাকা অবশ্যই কঠিন। কিন্তু সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের কাছে মানসিক শান্তিটাই আসল। তিনি মনে করেন, যখন মন অভিনয়ে ডুবে থাকে, তখন একরকম প্রশান্তি আসে, যা সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। তিনি বলেন, “শুটিংয়ে গেলে মনের কষ্ট আর থাকে না। বরং ভালো লাগে। কাজে থাকলে মনও ভালো থাকে।”
এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই যেন নিজের অস্তিত্বটাকে নতুন করে প্রমাণ করলেন সাবিত্রী। বয়স যতই হোক, শিল্পীর মনে যদি কাজ করার তাগিদ থাকে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা কখনও ফুরোয় না—তার কথায় সেই বার্তাই স্পষ্ট। এটি কেবল ব্যক্তিগত ইচ্ছার প্রকাশ নয়, বরং শিল্পের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং আত্মনিবেদনের গল্প। তার এই মানসিকতা নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের জন্যও এক বড় শিক্ষা, যে কীভাবে কাজকে ভালোবাসলে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা থেকে আনন্দ পাওয়া যায়।
‘চিরসখা’ ও বর্তমান ভূমিকা
বর্তমানে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে জি বাংলার জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘চিরসখা’-তে দেখা যাচ্ছে। এই ধারাবাহিকে তিনি কমলিনীর তুতো-শাশুড়ির চরিত্রে অভিনয় করছেন। এই বয়সেও তিনি যেভাবে নিয়মিত শুটিংয়ে অংশ নিচ্ছেন এবং তার চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তার উপস্থিতি ধারাবাহিকের গল্পে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে, এবং দর্শকরাও তার অভিনয় উপভোগ করছেন।
শেষ কথা: শিল্পের প্রতি দায়, নিষ্ঠা আর প্রকাশের আনন্দ
আজ যখন ছোট পর্দার বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠছে, এবং প্রবীণ শিল্পীরা একে একে অবসরের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তখন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় যেন দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক পুরনো মূল্যবোধকে আঁকড়ে। তার কাছে শিল্প মানেই দায়, নিষ্ঠা আর প্রকাশের আনন্দ। তিনি তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করে চলেছেন, একজন প্রকৃত শিল্পী কখনো অবসর নেন না। তাদের কাজই তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়। যতদিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর শক্তি থাকবে, ততদিন তারা কাজ করে যাবেন, কারণ এটাই তাদের জীবনের মূলমন্ত্র।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় শুধু একজন অভিনেত্রী নন, তিনি এক প্রতিষ্ঠান। তার দীর্ঘ এবং বর্ণাঢ্য কর্মজীবন, বিশেষ করে এই বয়সেও তার কাজের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা, বাংলাদেশের এবং পশ্চিমবঙ্গের বাংলা বিনোদন জগতের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তার এই মনোভাব নতুন করে মনে করিয়ে দেয়, শিল্পীর কাছে বয়স কেবল একটি সংখ্যা মাত্র, আসল হলো মনের জোর আর সৃষ্টিশীলতার অদম্য তাগিদ।
NG Videos news এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।