NG Videos News

Entertainment Unlimited

বুধবার ২০শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

NG Videos News

Entertainment Unlimited

বুধবার ২০শে আগস্ট, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
টেলি সামাদ

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে কিছু নাম এতটাই পরিচিত যে, তাদের আসল নাম প্রায়শই বিস্মৃত হয়। তেমনই একটি নাম টেলি সামাদ। তার আসল নাম আব্দুস সামাদ হলেও, এই নামেই তিনি আপামর জনসাধারণের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। পর্দায় তার উপস্থিতি মানেই হাসির রোল, অনবদ্য অভিনয় আর এক ভিন্ন ধরনের আনন্দ। কিন্তু কীভাবে একজন সাধারণ আব্দুস সামাদ হয়ে উঠলেন ‘টেলি সামাদ’ – এই কিংবদন্তি অভিনেতার জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে এক অনুপ্রেরণামূলক এবং চমকপ্রদ গল্প। আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদনে আমরা ডুব দেব টেলি সামাদের বর্ণাঢ্য জীবনে, জানব তার পথচলা, সংগ্রাম, সাফল্য এবং সেইসব অজানা গল্প যা তাকে করে তুলেছে আমাদের প্রিয় ‘টেলি সামাদ’।

শৈশব ও প্রথম ধাপ: মঞ্চ থেকে টেলিভিশনের হাতছানি

১৯৪৫ সালের ৮ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুস সামাদ। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে অভিনয়ের প্রতি ছিল এক অদম্য টান। স্কুল জীবনেই তিনি ঝুঁকে পড়েন মঞ্চ নাটকের দিকে। মুন্সীগঞ্জের স্থানীয় মঞ্চে তার অভিনয় প্রতিভার ঝলক দেখা যেতে শুরু করে অল্প বয়সেই। মঞ্চের উপর তার সরব উপস্থিতি, অসাধারণ সংলাপ বিতরণ এবং চরিত্রকে আত্মস্থ করার ক্ষমতা দর্শকদের মুগ্ধ করত। প্রতিটি মঞ্চ নাটকের শেষে তার জন্য বরাদ্দ থাকত তুমুল করতালির শব্দ – যা ছিল তার অভিনয়ের সার্থকতা।

সেই সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) একটি বিশেষ গুরুত্ব ছিল। টেলিভিশন ছিল নতুন এবং সম্ভাবনাময় একটি মাধ্যম। মঞ্চে আব্দুস সামাদের তুখোড় অভিনয় এবং দর্শকদের কাছ থেকে পাওয়া তার স্বীকৃতি টেলিভিশনের কর্তাব্যক্তিদের নজর এড়ায়নি। একদিন মঞ্চে অভিনয় করার সময় দর্শকদের করতালির শব্দই যেন তাকে টেলিভিশনের দিকে টেনে নিয়েছিল। এটি ছিল তার জীবনের এক সন্ধিক্ষণ।

‘টেলি সামাদ’ নামের জন্ম: এক ক্যামেরাম্যানের দূরদর্শী চিন্তা

আব্দুস সামাদের জীবনে ‘টেলি সামাদ’ নামটি আসে এক অপ্রত্যাশিত সূত্র থেকে। তিনি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন এই নামের পেছনের গল্প। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান মোস্তফা মামুন ছিলেন সেই মানুষটি, যিনি আব্দুস সামাদের আসল নামকে ছাপিয়ে একটি নতুন পরিচিতি দিলেন।

টেলি সামাদ স্মৃতির পাতা থেকে তুলে এনেছিলেন সেই দিনের কথা। তিনি বলেছিলেন, “একদিন বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে আমি আমন্ত্রিত হই। সেখানে বিটিভির ক্যামেরাম্যান মোস্তফা মামুন আমাকে দেখে বলেন, ‘সামাদ শোন, আজ থেকে তোর নাম টেলি সামাদ।’ সেই দিন থেকেই আমি আব্দুস সামাদ থেকে হয়ে গেলাম টেলি সামাদ।” মোস্তফা মামুনের এই দূরদর্শী চিন্তা যে আব্দুস সামাদকে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে, তা হয়তো সেদিন তিনিও পুরোপুরি আঁচ করতে পারেননি। কিন্তু এই নামকরণই আব্দুস সামাদকে একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি এনে দিয়েছিল, যা তাকে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে দিতে সহায়ক হয়েছিল। ‘টেলি’ শব্দটি টেলিভিশনের প্রতীক আর ‘সামাদ’ তার নামের অংশ – এই যুগলবন্দী এক নতুন তারকার জন্ম দিল।

শিক্ষাজীবন: চারুকলার এক অপ্রচলিত পথ

অনেকেই হয়তো জানেন না, টেলি সামাদের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল একেবারেই ভিন্ন। তিনি চিত্রকলার একজন ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এই বিষয়টি তার সৃজনশীল সত্তার আরও একটি দিক উন্মোচন করে। যদিও তিনি তার পড়াশোনার বিষয় থেকে ভিন্ন পথে পা বাড়িয়েছিলেন, তবুও চারুকলার জ্ঞান তার অভিনয় জীবনে হয়তো সূক্ষ্মভাবে প্রভাব ফেলেছিল – বিশেষ করে চরিত্রের ভেতরের সৌন্দর্য এবং অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে। তিনি নিজেই জানতেন না যে তিনি এক বিষয়ে পড়াশোনা করছেন, আর তার প্রতিভা প্রকাশ পাবে অন্য এক ভিন্ন ক্ষেত্রে। এটি ছিল ভাগ্যের এক অদ্ভুত পরিহাস, যা তাকে চিত্রশিল্পী না বানিয়ে দেশের সেরা কৌতুক অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু: ‘কার বউ’ থেকে ‘নয়নমনি’র ঝড়

টেলি সামাদের চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ ঘটেছিল বেশ আগে। নজরুল ইসলাম পরিচালিত ১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কার বউ’ সিনেমার মাধ্যমে তিনি বড় পর্দায় আত্মপ্রকাশ করেন। তবে এই ছবিটি তেমন একটা সাড়া জাগাতে পারেনি, যার ফলে টেলি সামাদও তখনো তেমন পরিচিতি লাভ করেননি। এটি ছিল তার দীর্ঘ পথচলার প্রথম সিঁড়ি।

টেলি সামাদ

তবে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয় প্রখ্যাত পরিচালক আমজাদ হোসেন। ১৯৭৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘নয়নমনি’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পান টেলি সামাদ। এই ছবিটি ছিল তৎকালীন সময়ের এক সুপার-ডুপার হিট সিনেমা। ‘নয়নমনি’ শুধু বক্স অফিসেই ঝড় তোলেনি, এটি রাতারাতি টেলি সামাদকে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে এবং সারা দেশে পরিচিতি এনে দেয়। এই ছবির সাফল্যের পর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘নয়নমনি’ ছবিতে তার অনবদ্য অভিনয় দর্শকদের এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, পরিচালক ও প্রযোজকরা তাকে নিয়ে কাজ করার জন্য আগ্রহ দেখাতে শুরু করেন। এরপর থেকে তিনি নিয়মিতভাবে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে থাকেন এবং একের পর এক সফল সিনেমায় তার উপস্থিতি দর্শকদের হাসির খোরাক যোগাতে থাকে।

বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার: ৬০০ ছবি, ৫০ গান, প্রযোজক ও সুরকার

টেলি সামাদের অভিনয় জীবন ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং বহুমুখী। তিনি প্রায় ৬০০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন, যা তাকে বাংলাদেশের অন্যতম ব্যস্ত এবং জনপ্রিয় অভিনেতাদের কাতারে নিয়ে আসে। কমেডি চরিত্রে তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। তার শারীরিক ভাষা, মুখের অভিব্যক্তি এবং সংলাপ বলার নিজস্ব স্টাইল তাকে অন্যান্য অভিনেতাদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল। তিনি কৌতুক অভিনেতা হিসেবেই বেশি পরিচিতি লাভ করলেও, চরিত্র অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন যেকোনো ধরনের চরিত্রে।

শুধু অভিনয়ই নয়, টেলি সামাদের ছিল এক ভিন্ন প্রতিভা। তিনি একজন অসাধারণ কণ্ঠশিল্পীও ছিলেন। প্রায় ৫০টি ছবিতে তিনি গান গেয়েছেন। তার গাওয়া গানগুলোও দর্শকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তার কণ্ঠ ছিল তার অভিনয়ের মতোই স্বকীয়।

এছাড়াও, তিনি একটি ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। ছবিটির নাম ছিল ‘মনা পাগলা’। এই ছবিটি শুধুমাত্র তার সঙ্গীত পরিচালনায় নয়, তিনি এই ছবিটির প্রযোজকও ছিলেন। কাজী হায়াৎ পরিচালিত এই ছবিটি টেলি সামাদের বহুমুখী প্রতিভার প্রমাণ। প্রযোজক হিসেবে তার এই উদ্যোগ দেখায় যে তিনি শুধু ক্যামেরার সামনেই নয়, ক্যামেরার পেছনেও কতটা সক্রিয় ছিলেন।

‘মনা পাগলা’ ছবিটির সঙ্গেই তার ব্যক্তিগত জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় জড়িয়ে আছে। এই ছবির নায়িকাকেই তিনি পরবর্তীতে বিয়ে করে সংসার পেতেছিলেন। তাদের সুখের সংসারে এক ছেলে এবং দুই মেয়ে রয়েছে। এটি তার শিল্পী জীবনের পাশাপাশি পারিবারিক জীবনেরও এক সুন্দর চিত্র তুলে ধরে।

উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রসমূহ: কালজয়ী কাজের তালিকা

টেলি সামাদ তার দীর্ঘ অভিনয় জীবনে অসংখ্য কালজয়ী চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের তালিকা নিচে দেওয়া হলো:

  • কার বউ (১৯৬৬): তার প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র।
  • নয়নমনি (১৯৭৬): যে ছবি তাকে রাতারাতি তারকা বানিয়েছিল।
  • সুজন সখি: রোমান্টিক কমেডিতে তার নিজস্বতার ছাপ।
  • মনা পাগলা: তার প্রযোজিত ও সঙ্গীত পরিচালিত ছবি।
  • গোলাপী এখন ট্রেনে: বিখ্যাত এই ছবিতে তার চরিত্র ছিল স্মরণীয়।
  • নাগর দোলা: সামাজিক প্রেক্ষাপটে তার অনবদ্য অভিনয়।
  • ভাত দে: এটি ছিল তার ক্যারিয়ারের অন্যতম শক্তিশালী অভিনয়।
  • পায়ে চলার পথ: ভিন্নধর্মী গল্পে তার উপস্থিতি।
  • মাটির পুতুল: গ্রামীণ পরিবেশে তার হাস্যরস।
  • নতুন বউ: তার কমেডি দর্শকদের মন জয় করেছিল।
  • মন বসে না পড়ার টেবিলে: এই শিরোনামের একাধিক ছবিতে তার অবদান ছিল।
  • মিস লোলিটা: তার কৌতুক চরিত্র ছিল অত্যন্ত উপভোগ্য।

এই চলচ্চিত্রগুলো টেলি সামাদের অভিনয় জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এবং প্রমাণ করে যে তিনি কেবল একজন কৌতুক অভিনেতা ছিলেন না, বরং একজন পরিপক্ক এবং ভার্সাটাইল শিল্পী ছিলেন।

পারিবারিক পরিচয় ও সম্মানীয় আত্মীয়তা

টেলি সামাদের পারিবারিক পরিচয়ও বেশ সমৃদ্ধ ছিল। তার আপন ভাই ছিলেন বিখ্যাত চারুশিল্পী আব্দুল হাই। এটি আবারও প্রমাণ করে যে তাদের পরিবারে শৈল্পিক প্রতিভার ছড়াছড়ি ছিল।

আরও চমকপ্রর বিষয় হলো, বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন তার চাচা। এই ধরনের একটি সম্মানীয় পারিবারিক সম্পর্ক তার ব্যক্তিত্বে আরও এক নতুন মাত্রা যোগ করে। যদিও তিনি কখনো তার পারিবারিক প্রভাবকে কাজে লাগাননি, বরং নিজের মেধা আর শ্রম দিয়েই তিনি নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন চলচ্চিত্র জগতে।

শেষ জীবন ও বিদায়: এক কিংবদন্তির প্রয়াণ

টেলি সামাদের শেষ জীবন ছিল স্বাস্থ্যগত জটিলতায় পূর্ণ। ২০১৭ সালে তার হৃদপিণ্ডে বাইপাস সার্জারি করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এই সার্জারি তার শারীরিক অবস্থাকে আরও দুর্বল করে তোলে। ২০১৮ সালের শেষ দিকে তার রক্তে লোহিত রক্তকণিকার স্বল্পতা দেখা দেয়, যা তাকে ভীষণভাবে অসুস্থ করে তোলে।

এছাড়াও, তিনি খাদ্যনালীতে সমস্যা, বুকে সংক্রমণ এবং ডায়াবেটিসের মতো একাধিক জটিল রোগে ভুগছিলেন। এই অসুস্থতাগুলো তার শেষ জীবনের অনেকটা সময় হাসপাতালের বিছানাতেই কাটাতে বাধ্য করে। তার শারীরিক অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছিল।

অবশেষে, ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল দুপুরে এই কিংবদন্তি অভিনেতা অসুস্থতাজনিত কারণে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। একজন অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী, প্রযোজক এবং সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে টেলি সামাদ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে অবদান রেখে গেছেন, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

স্মরণে টেলি সামাদ: এক অবিস্মরণীয় কিংবদন্তি

আব্দুস সামাদ থেকে ‘টেলি সামাদ’ হয়ে ওঠার এই পথচলা ছিল সংগ্রাম, সাধনা এবং সাফল্যের এক অনন্য উপাখ্যান। তিনি তার কৌতুক দিয়ে দর্শকদের হাসিয়েছেন, আবার কখনো তার মর্মস্পর্শী অভিনয়ে দর্শকদের হৃদয়ে দাগ কেটেছেন। তার অভিনয় ছিল স্বকীয়, তার কণ্ঠ ছিল মুগ্ধকর।

টেলি সামাদ কেবল একজন অভিনেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বিনোদক, একজন শিল্পী যিনি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে জানতেন। তার প্রয়াণ হয়তো হয়েছে, কিন্তু তার সৃষ্টিকর্ম এবং তার স্মৃতি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে চিরকাল অমলিন থাকবে। নতুন প্রজন্মের অভিনেতাদের জন্য তিনি এক অনুপ্রেরণা, কীভাবে নিজের মেধা এবং শ্রম দিয়ে একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি গড়ে তোলা যায় তার এক জীবন্ত উদাহরণ। টেলি সামাদ নামটির মাঝেই লুকিয়ে আছে একজন মানুষের কঠোর পরিশ্রম, সৃষ্টিশীলতা এবং ভালোবাসার এক অপূর্ব সমন্বয়। তার নাম যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন তার অবদানও অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

NG Videos news এর সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।